প্রতিনিধি:-
সঠিক আর্থিক নীতি এবং দুর্নীতি থাকলে কোন দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়া এই দেশটিকে ভারত মহাসাগরের মুক্তো বলা হত। সেই দেশের এমন বেহাল অর্থনীতি হল কী করে এবং এর ফলে দেশটির বর্তমান অবস্থা কীকরম?
বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। দিনে ১৩ ঘন্টা বিদ্যুত্ নেই, আগামী দিনে হয়ত ১৬ ঘন্টা বিদ্যুত্ থাকবে না। চাল, ডাল, চিনি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আগুন। ওষুধ সংকট, জ্বলানী তেলের অভাব সব মিলিয়ে দেশটির অবস্থা শোচনীয়। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে এক কেজি চালের দাম ৫০০ টাকা, এক কাপ চা ১০০ টাকা। রান্নার গ্যাসের জন্য দোকানে দীর্ঘ লাইন, লাইনে দাঁড়িয়ে গত কয়েকদিনে অন্তত ৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কলম্বো সহ অনেক শহরে বিক্ষোভ চলছে। মূলত দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়ে রাজপক্ষ কে পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছে মানুষ। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে আগামী ৩৬ ঘন্টার জন্য শ্রীলঙ্কায় জরুরী অবস্থা জারি করে পুলিশ ও সেনা নামাতে হয়েছে। ২০২০ সাল থেকেই শ্রীলঙ্কার আর্থিক পরিস্থিতিতে ধ্বস নামতে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ এর তথ্য অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ২০২০ সালেই ৭০ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক লোন জিডিপির ৯৪ শতাংশ ছিল, ২০২২ সালে এটা গিয়ে দাড়িয়েছে ১১৯ শতাংশে। শুধু ২০২২ সালেই শ্রীলঙ্কাকে ৭ বিলিয়ন ডলার লোন শোধ করতে হবে, এদিকে বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। যেকোন মহূর্তে দেওলিয়া হয়ে যেতে পারে শ্রীলঙ্কা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে শ্রীলঙ্কার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০১৯ সালে গোটাবায়া রাজপক্ষে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি হবার পর থেকেই দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে শুরু করে। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ ৭.৫ বিলিয়ন ডলার ছিল সেখান থেকে গত ডিসেম্বরে আসে ৩.১ বিলিয়ন ডলার এবং বর্তমানে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে এসে দাড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে দেশটিতে, যা ২০০৮ সালের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা একই।
শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থা এতটাই করুন যে ছাত্র ছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে পারছে না কাগজের অভাবে। দুটি প্রথম শ্রেনীর নিউজপেপার বন্ধ হয়ে গেছে শুধু কাগজের অভাবে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এতটা খারাপ অবস্থায় কোনওদিন পরেনি শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে ১ আমেরিকান ডলার = ২৭৬.৯৩ শ্রীলঙ্কান রুপি, ১৮০.৩৮ পাকিস্তানি রুপি। যখন ডলারের বিপরীতে কোন দেশের মুদ্রার দাম পড়ে যায় তখন সেই দেশটির আমদানিতে বেশী টাকা লাগে যার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশটির নিজস্ব বাজারে। সোজা ভাষায় বুঝিয়ে বললে ধরুন শ্রীলঙ্কা আমেরিকা থেকে ১০০০ টাকা ধার চাইল। যেসময় লোন চাইল সেসময় হয়ত ১ডলার = ১০০ শ্রীলঙ্কান রুপি ছিল, মানে আমেরিকা ১০ ডলার ধার দিলে সেটা শ্রীলঙ্কান মুদ্রায় ১০০০ টাকা হত। এবার এখন ১ ডলার = ২৭৭ শ্রীলঙ্কান রুপি অর্থাত্ এখন আমেরিকার ১০ ডলার শোধ করতে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ২৭০০ টাকা দিতে হবে যা আগের তুলনায় আড়াই গুন বেশী। এরকম প্রচুর লোন কয়েকগুন বেশী হারে শ্রীলঙ্কাকে শোধ করতে হচ্ছে। কোন দেশ যদি আমদানি বেশী করে অর্থাত্ রপ্তানির থেকে আমদানি বেশী হয় তাহলে দেশটির অর্থনীতি ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার উদাহরণ এই শ্রীলঙ্কা। সেজন্য কোন দেশের আমদানি ও রপ্তানি প্রায় সমান হওয়া দরকার। কারন কোন দেশ যদি অন্য কোন দেশ থেকে কিছু কিনতে যায় তাকে আমেরিকান ডলারে কিনতে হবে। কারন বিশ্বে আমেরিকান ডলারকে সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা বলা হয়। এবার শ্রীলঙ্কা শুধু আমদানি করে যাচ্ছে, রপ্তানি খুব কম করত যার ফলে ডলার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গত জুলাই মাসে শুধু বন্ড মেটাতেই শ্রীলঙ্কা কে ১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে খরচা করতে হয়েছিল। বন্ড কি জিনিস? ধরুন ভারত সরকারের লোন লাগবে সরকার দুই ভাবে লোন পেতে পারে এক নিজ দেশবাসীর কাছ থেকে এবং বিদেশ থেকে। বিদেশ থেকে লোন নেবার জন্য ট্রেজারি বিলে সরকার লিখে দেয় ৮ শতাংশ কি ৯ শতাংশ কত সুদের হারে লোন নেবে, একেই বন্ড বলে। এই বন্ডে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আসে ফলে সরকার ডলার পেয়ে যায়।এবার জানা যাক শ্রীলঙ্কার হঠাত্ এমন আর্থিক বেহাল অবস্থার কারন কী? শ্রীলঙ্কার এমন দুর্দশা একদিনে হয় নি গত ১৫ বছর ধরে ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হতে থাকে শ্রীলঙ্কার।
১) অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প:- শ্রীলঙ্কা সরকার এমন কিছু প্রকল্প শুরু করে যা যথেষ্ট ব্যায়বহুল কিন্তু অর্থহীন। কলম্বো পোর্ট সিটি এমনই এক প্রকল্প। শ্রীলঙ্কা তাদের রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্রের বুকে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে একটি শহর তৈরি করছে। ২৫ বছরে এই প্রজেক্টে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার খরচা হবে। এই অর্থের জন্য শ্রীলঙ্কা চীন থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার উচ্চসুদে ধার নিয়েছে। এছাড়াও হাম্বানটোটা বন্দর ও শ্রীলঙ্কা একই ভাবে লোনের ফাঁদে পড়ে ৯৯ বছরের জন্য চীনা কোম্পানিকে দিতে বাধ্য হয়েছে। লোন পরিশোধের জন্য হাম্বানটোটা বন্দর সহ তার পাশের ১৫,০০০ একর জমি নিয়েছে চীন যেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা হবে। আগামী ৪০ বছর ধরে এই শিল্পান্চলে চীন ব্যাবসায়ীরা বিনা করে ব্যাবসা করবে। এই মহূর্তে শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক লোন প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলার যার মধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলার শুধু চীন থেকে নেওয়া। শ্রীলঙ্কার এসব প্রজেক্ট সাদা হাতির মত এখন। এখান থেকে তেমন কিছুই লাভ হয়নি শ্রীলঙ্কার।
২) ট্যাক্স কমানো:- ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে কর কমান অনেক। সরকারি কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে পুরো অর্ধেক বা ৮ শতাংশ করে দেওয়া হয়, এতে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যায় যার জন্য সরকার বাধ্য হয় বাইরে থেকে লোন নিতে। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার তত্কালীন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ্রা রাজাপক্ষে ও একই নীতি নিয়েছিল কিন্তু সেবার কোন সমস্যা হয়নি কারন তখন করোনার মতন কোন মহামারী আসে নি।
৩) পর্যটন খাতে বিপর্যয় :- শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় উত্স তাদের পর্যটন শিল্প। করোনা মহামারীর কারনে সবচয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শ্রীলঙ্কান অর্থনীতি। পর্যটন ও বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের থেকে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হত শ্রীলঙ্কার কিন্তু করোনার জন্য এসব সেক্টরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
৪) অর্গানিক চাষে বিপর্যয় :- শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি বিপর্যয়ের প্রধান কারন হিসাবে অর্গানিক চাষকেই দায়ী করা হয়। এটা পুরো ম্যান মেড ডিসাস্টার। গত বছর ২৯ এপ্রিল শ্রীলঙ্কা সরকার সমস্ত কেমিক্যাল সার আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। শ্রীলঙ্কা সরকার চাইছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বা পুরো বিশ্বে শ্রীলঙ্কাকে অর্গানিক চাষের মডেল হিসাবে তুলে ধরতে। দেখুন কেমিক্যাল থেকে অর্গানিক চাষ সত্যিই দারন, এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু একটা গোটা দেশকে রাতারাতি অর্গানিক চাষের দেশ হিসাবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত ছিল চরম ভুল। এর ফলে হল কী খাদ্যশস্য উত্পাদন কমে গেল কারন রাতারাতি কেমিক্যাল সার উত্পাদন বন্ধ করে দিলে খাদ্য উত্পাদন কমে যায়। এমনকী শ্রীলঙ্কা সিনামন, রাবার, পিপার, নাটমেগ সহ অনেক জিনিস রপ্তানি করত কিন্তু উত্পাদন কম হওয়ায় এসব জিনিস রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যায়। চিনির দাম বেড়ে ২০০ টাকা প্রতি কেজি হয়ে যায়। চালের উত্পাদন ২০ শতাংশ কমে যায়। যে শ্রীলঙ্কা কোনওদিন চাল আমদানি করত না তারা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল ক্রয় করে। শ্রীলঙ্কান রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপক্ষে ৪৬ এক্সপার্ট দের সাহায্য নিয়ে শ্রীলঙ্কায় ১০০ শতাংশ অর্গানিক চাষ চালু করে। এদের মধ্যেই চা শিল্পের সাথে যুক্ত একজন বিশেষজ্ঞ হারমান গুনরত্নে সরকার কে সতর্ক করে জানান এই সিদ্ধান্তের ফলে চায়ের উত্পাদন অর্ধেক কমে যাতে পারে, সাথে সাথে চায়ের দাম অন্তত ১০ গুন বেড়ে যাবে। শ্রীলঙ্কায় প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়ন কেজি চা উত্পন্ন হয়। শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে বেশী চা রপ্তানি করে, বছরে প্রায় ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের চা রপ্তানি করে। অর্গানিক চাষের ফলে দাম বৃদ্ধি পাবার জন্য চা রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায় যার প্রভাব পড়ে বৈদেশিক রিজার্ভে। শুধু চা উত্পাদনে ৮৯ শতাংশ কেমিক্যাল সার দরকার, রাতারাতি বন্ধ করে দিলে তার প্রভাব তো পড়বেই। অর্গানিক চাষের সিদ্ধান্ত কতটা অবিবেচকের মত সিদ্ধান্ত তা এই তথ্যটা পড়লে বুঝতে পারবেন। অর্গানিক সার আসে কোথা থেকে? গৃহস্থালির উচ্ছিষ্ট জিনিস থেকে। শ্রীলঙ্কায় প্রতিদিন ৩৫০০ টন উচ্ছিস্ট হয়। এই হিসাবে প্রতিবছর এর থেকে ২-৩ মিলিয়ন টন অর্গানিক সার তৈরি সম্ভব। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় প্রতিবছর শুধু প্যাডি তৈরিতেই ৪ মিলিয়ন টন এবং চা উত্পাদনে ৩ মিলিয়ন টন অর্গানিক সার লাগে, বাকি গুলো বাদই দিলাম। সুতারং বুঝতেই পারছেন একটি শস্য উত্পাদনের জন্যই প্রয়োজনীয় অর্গানিক সার নেই।ভারত শ্রীলঙ্কাকে ১ বিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আর্থিক অবস্থা ঠিক হবার পর শ্রীলঙ্কা শোধ করে দেবে। এছাড়াও ভারত ৪০,০০০ মেট্রিক টন ডিজেল ও ৪০,০০০ টন চাল দিতে চলেছে শ্রীলঙ্কাকে। তবে শ্রীলঙ্কার এই মহূর্তে বাঁচার একটাই উপায় আছে তা হচ্ছে আইএমএফের কাছে সাহায্য চাওয়া যা ইতিমধ্যে করে ফলেছে শ্রীলঙ্কা। আসলে চট করে আইএমএফের কাছে সাহায্য কেউ চায় না, কারন আইএমএফের লোন দেবার কিছু শর্ত আছে। আইএমএফ কে নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিমা দেশগুলো। আইএমএফ লোন দেবার সাথে সেই টাকা কিভাবে খরচ করতে হবে সেই ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করে। সোজা কথায় আইএমএফ সেই দেশের আভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপ করে তাই একদম জরুরি না হলে আইএমএফের কাছে কেউ যেতে চায় না। কিন্তু শ্রীলঙ্কার প্রায় দেওলিয়া অবস্থা তাই শ্রীলঙ্কার কিছু করার নেই।