বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সাংসদ জহর সরকারের রাজ্যসভা ও দল থেকে পদত্যাগ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ বড়রকম পালাবদল না ঘটলে তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদের অপসারণ অনিবার্য। তৃণমূল নেতাদের লাগামছাড়া দুর্নীতি সামনে আসার পর বিস্ফোরক বার্তা দিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন আমলা, সাংসদ জহর সরকার। তৃণমূলের একাংশ ‘পচে’ গিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। এও বলেছিলেন, তাঁর পরিবার-পরিজনরা চাইছেন না তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকেন। এর পরেই তৃণমূল খড়্গহস্ত হয় তাঁর বিরুদ্ধে। দলীয় শৃঙ্খলানির্ণায়ক কমিটির তরফে ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজ্যসভার ‘চিফ হুইপ’ সুখেন্দু শেখর রায়ের সূত্রে দলের তরফে কড়া বার্তা দেওয়া হয় জহরকে। সূত্রের দাবি, জহর ইতিমধ্যেই সুখেন্দুর মারফত তাঁর অবস্থান তুলে ধরেছেন দলের কাছে। তাঁর বক্তব্য, অন্য কারুর প্ররোচনায় তিনি আমল দিতে নারাজ। একমাত্র দলনেত্রী চাইলেই তিনি পদত্যাগ করতে তৈরি।
তৃণমূল বনাম জহর সরকারের এই ঠাণ্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে যখন উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি, পাশাপাশি ঠিক তখনই উঠে এসেছে অন্য একটি সমীকরণ। মনে করা হচ্ছে, জহরকে সরিয়ে রাজ্যসভায় দলের নয়া সদস্য রূপে প্রজেক্ট করা হতে পারে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক ও মুখপাত্র কুণাল ঘোষকে। জহর সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে ক্রমশ কুণাল ঘোষের উপরেই আস্থা রাখতে চাইছে দল। কিন্তু জহর ও কুণালের মধ্যে ‘হেভিওয়েট’ সাংসদ হওয়ার মতো ক্ষমতা কে রাখেন, তা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে বিচার-বিশ্লেষণ। এই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক দলের এক বর্ষীয়ান নেতা জানিয়েছেন, ‘জহরবাবু দুঁদে আমলা, বহুদিনের অভিজ্ঞ। সংসদ ভবনে তাঁর পারফরম্যান্সও খারাপ নয়৷ সুপণ্ডিত, বাগ্মী বলে খ্যাতিমান৷ কিন্তু যে কাণ্ড তিনি বাঁধিয়ে ফেলেছেন তা সর্বৈব রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয়, যা ক্ষমা করা যায় না।’বর্ষীয়ান ওই নেতা এও বলেন, ‘একটি দল একটি পরিবারের মতন। সেখানে নানা প্রকৃতির মানুষ রয়েছে, খারাপ ভালো মিশিয়েই। পরিবারে কারুর কাজকর্ম নিয়ে খারাপ লাগলে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর কাছে নালিশ জানানোই রীতি৷ তা না করে গোটা পাড়ায় ঢাক পিটিয়েছেন জহর।’ প্রবীণ ওই নেতার দাবি, ‘জহরবাবু ক্ষোভ ব্যক্ত করার বহু সুযোগ পেয়েছিলেন। যেমন গত বাদল অধিবেশনের সময় দিল্লিতে এসেছিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সুখেন্দু শেখর রায়ের বাস ভবনে দলীয় সাংসদদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে সংবাদমাধ্যমও ছিল না৷ এমনকি পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গ্রেপ্তার হওয়া অর্পিতা-পার্থকে নিয়ে আলোচনা করেন, সেখানেও ছিলেন তিনি৷ অথচ টুঁ শব্দটিও করেননি। দলের ‘কোর কমিটি’র বৈঠকেও মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন জহর৷ হঠাৎ করে সংবাদমাধ্যমের সামনেই তাঁর বিবেক জাগ্রত হল, এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ প্রবীণ ওই নেতার মতে, ‘ভুল সময়ে ভুল বার্তা দিলেন জহর। যে কঠিন সময়ে দলের পাশে দাঁড়ান উচিত, তা না করে দলকে বিপদে ফেললেন। এর শাস্তি তাঁকে পেতে হবে।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘শাস্তি’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন ওই প্রবীণ নেতা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের মতে, জহর সরকারের ছাঁটাই এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা৷ শৃঙ্খলা নির্ণায়ক কমিটির রিপোর্ট জমা পড়লেই নেওয়া হবে কড়া পদক্ষেপ৷ সেক্ষেত্রে রাজ্যসভার পদ ও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ দুটিই খারিজ হতে পারে রাজ্য ক্যাডারের এই বর্ষীয়ান আমলার। পাশাপাশি এই মুহূর্তে রাজ্যসভায় সম্ভাব্য শূন্যপদে কাকে বহাল করতে চায় দল, সে নিয়েও জল্পনা তুঙ্গে৷ দলীয় কানাঘুষোয় উঠে এসেছে কুণালের নাম। জহর ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রিক্রুট’, সেক্ষেত্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রিক্রুট’ হিসেবে ফের রাজ্যসভার দাবিদারি রাখতে পারেন কুণাল ঘোষ। বর্ষীয়ান ওই নেতার দাবি, ‘কুণাল জহর সরকারের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিত কখনওই নন। কিন্তু তিনি বিচক্ষণ বক্তা, কোন কথা কোথায় বলতে হয়, সেই স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞান তাঁর যথেষ্ট আছে। রাজ্যসভা সাংসদ রূপে আগেও কাজ করেছেন তিনি। ফলে সেই অভিজ্ঞতাকে দ্বিতীয়বার কাজে লাগাতেই পারে দল। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন একজনই-তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’যদিও গোটা বিষয় নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশে৷ তাঁরা মনে করেন, কেন হঠাৎ জহরের বিকল্প হিসেবে কুণাল’কে তালিকায় রাখা? প্রশ্ন এও উঠেছে কুণাল নিজেও পার্থর গ্রেপ্তারি নিয়ে একাধিকবার প্রকাশ্যে মুখ খুলেছিলেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নয় কেন? জুলাই মাসে মন্ত্রীসভার বৈঠকের আগে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বহুবার পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিস্ফোরক টুইট করেছিলেন। টুইটে কুণাল লেখেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এই মুহূর্তে দল থেকে বহিষ্কার করা উচিত। পার্থ’র মন্ত্রিত্ব কেড়ে দলের সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। তাঁর এই দাবি ভুল হলে পার্টির সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে তাঁকে সব পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার। তিনি তৃণমূলের এক বিশ্বস্ত সৈনিক হয়ে থাকবেন বলে টুইটে লিখেছিলেন কুণাল। মজার বিষয়, কুণাল ঘোষের সেই দাবিকে দরাজ সমর্থন জানান দলীয় মুখপাত্র বিশ্বজিৎ দেব, যিনি সম্প্রতি একই ইস্যুতে জহর সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সে সময় তিনিও দাবি করেছেন একজন নেতার জন্য দলের অন্য কর্মীদের মাথা হেঁট হচ্ছে। দলের বদনাম হচ্ছে। সাধারণ কর্মীদের কথা ভেবে টিএমসি শীর্ষ নেতৃত্বের উচিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কার করা। নইলে দলের নীচু তলার কর্মীদের কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা কিন্তু অকারণে মাথা হেঁট করে থাকছেন। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।সূত্রের দাবি, এ নিয়েই ঘনিষ্ঠ মহলে প্রশ্ন তুলেছেন জহর সরকার স্বয়ং৷ তাঁর বক্তব্য, তাঁর বিরুদ্ধে যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়, কুণালের ক্ষেত্রে কেন তা হবে না? নাকি পুরো বিষয়টাই একটা ষড়যন্ত্র, তাকে সরিয়ে কুণালকে রাজ্যসভায় জায়গা করে দেওয়ার? মূলত এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। মমতা ও অভিষেকের মিলিত হস্তক্ষেপে জহর যদি এ যাত্রায় বেঁচে যান, দল যদি তাঁকে দ্বিতীয় সুযোগ (যেমন দেওয়া হয় কুণালকেও) সেটাই হবে সবচেয়ে বড় ‘মিরাকল’, তবে সে সম্ভাবনা তলানিতে বলেই মনে করছেন শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ। জহরের ‘পতন’ ও কুণাল ঘোষের ‘উত্থানে’র সাক্ষী হবে কি না রাজ্যসভা, এ মুহূর্তে সেদিকেই নজর রাখছেন সকলে।