প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধাঃ-
পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার বিকেলে নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় । ৭ নম্বর লোক কল্যাণ মার্গে স্থিত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলে তাঁদের বৈঠক, সে বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া টাকার খতিয়ান তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেন্দ্রের কাছে রাজ্য সরকারের বকেয়া বাবদ ১ লক্ষ ৯৬৮ কোটি ৪৪ হাজার টাকার হিসাব পেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর মধ্যে মনরেগায় ৬,৫৬১.৫৬ কোটি, পিএম আবাস যোজনায় ৯,৩২৯.৭৬ কোটি, পিএম গ্রামীন সেবায় ২,১০৫ কোটি, একদশক ধরে বাকি থাকা সমগ্র শিক্ষা মিশনে ১৫৮৬৪.৮৪ কোটি, মিড ডে মিলে ১৭৪.৭০ কোটি, ২০১৮ সাল থেকে বাকি ছিটমহল আদান-প্রদানের ১০৮ কোটি, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীন খাদ্যে ভর্তুকি বিষয়ক ১,২৬৩.৯৭ কোটির মত একাধিক খাতে বকেয়ার লম্বা হিসেব মুখ্যমন্ত্রী এদিন তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
পাশাপাশি, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে ৭৪৩.৩৭ কোটি, কেলেঘাই ও কপালেশ্বরী নদীতে বন্যাত্রাণে ১৭৮. ৩০ কোটি সহ রাজ্যের তফসিলি জাতি-উপজাতি সমাজে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি বাবদ ২৭৪.৩১ কোটির বকেয়া হিসেবও এদিন প্রধানমন্ত্রী সমীপে সার্বিক বকেয়া খতিয়ানের অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এর সাথে; বুলবুল, আমফান ও ইয়াস সাইক্লোনে ক্ষয়ক্ষতি বাবদ প্রায় ৬০ হাজার ৬২৯ কোটিও স্থান পেয়েছে এই বকেয়া তালিকায়। সূত্র অনুযায়ী আপাদমস্তক সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে আজ সম্পন্ন হয় মোদি-মমতার বৈঠক। প্রত্যাশিত ভাবেই খালি হাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে যাননি রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী৷ দিল্লির বাঙালি মহল্লা চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে দই, নানাবিধ মিষ্টি ও উত্তরীয় মোদির জন্য নিয়ে গেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সৌজন্য স্বরূপ হলুদ গোলাপের ‘বোকে’ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। পরে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী নিবাস থেকে বেরিয়ে সরাসরি তিনি হাজির হন রাষ্ট্রপতি ভবনে। নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গেও এদিন সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ১৫ মিনিটের বৈঠকেও রাষ্ট্রপতির জন্য দই, মিষ্টি, উত্তরীয় ও হলুদ গোলাপের ‘বোকে’ উপহার দিয়ে সৌজন্য রক্ষা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের দাবি, দ্রৌপদীকে কলকাতা আসার জন্য আমন্ত্রণও জানিয়েছেন তিনি।কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মোদি-মমতার এই সাক্ষাৎ নিতান্তই ‘সাদামাটা’ মনে হলেও এহেন সমীকরণে আস্থাশীল নয় বিশেষজ্ঞ মহল। এদিন বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা বলেন নি মুখ্যমন্ত্রী। সাধারনত প্রত্যেকবারই তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে বৈঠকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেন। তবে এবার মুখ্যমন্ত্রীর অপ্রত্যাশিত ‘নীরবতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল, দিল্লি পৌঁছে বর্ষীয়ান সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়ের বাসভবনে দলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সংসদ অধিবেশনের শেষ সপ্তাহে দলীয় রণকৌশলও নির্ধারণ করে দেন তিনি। এর পর, মাত্র আধঘন্টার মাথায় অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান মমতা। স্বভাববিরুদ্ধভাবে এড়িয়ে যান সংবাদমাধ্যমকে। শুক্রবার সকালে সংসদের সেন্ট্রাল হলেও যাননি মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের দাবি, রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি ও পার্থ-অর্পিতা প্রসঙ্গে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে চাওয়ার জন্যই, দলীয় সাংসদদের পরামর্শে সংসদ সফর বাতিল করেন তিনি। আগাগোড়া এ বারের দিল্লি সফরকে তিনি ‘বিতর্কমুক্ত’ রাখতে চাইছেন বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এর পরেই কেন্দ্রীয় রাজনীতির অন্দরমহলে শুরু হয়েছে তীব্র জল্পনা। প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত গা বাঁচিয়ে চলছেন মুখ্যমন্ত্রী? কেন তাঁর এই অপ্রত্যাশিত ‘মৌনতা? তবে কী ১ লক্ষ ৯৬৮ কোটির দাবিদাওয়া শুধুই মুখোশ? নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও গভীর ও জটিল সমীকরণ বা বোঝাপড়া?
শিক্ষাক্ষেত্রে গগনচুম্বী দুর্নীতি, প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজন অর্পিতা মুখার্জীর গ্রেপ্তারি নিয়ে এই মুহূর্তে অগ্নিগর্ভ রাজ্য রাজনীতি। গোটা বিষয়টি নিয়ে ‘ব্যাকফুটে’ থাকা শাসকদল তৃণমূল, এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে দায় ঝেড়ে ফেলতে উদ্যোগী। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংগঠনিক সংস্কারের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল নিয়ে এসেছেন মমতা। তবুও শাসকদলের প্রভাবশালী নেতাদের ‘কেচ্ছা’ এবং দলীয় ভাবমূর্তিতে ‘দুর্নীতির আতুরঘরে’-র তকমা সরাতে হিমশিম খাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রতিনিয়ত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বাছা বাছা অভিযোগ আর কটাক্ষের তির ছুঁড়ে দিচ্ছেন বিরোধীরা। ঠিক সেই আবহে মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফর ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে তোপ দেগেছে কংগ্রেস, বিজেপি ও বামেদের মত বিরোধী শিবির। তাঁদের মতে, রাজ্য সরকারের বকেয়ার দাবিদাওয়া নিতান্তই ‘লোক দেখানো’, লাগামছাড়া দুর্নীতি ও কেন্দ্রীয় এজেন্সির সক্রিয় পদক্ষেপে কার্যত ‘নাভিশ্বাস’ উঠে যাওয়া অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই দিল্লিতে ‘সেটিং’ করতেই গেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ সেই জল্পনা আরও বেশি করে উস্কে দিয়েছে তাঁর অভাবনীয় ‘মৌনতা’ ও সংবাদ মাধ্যম থেকে নিরাপদ দূরত্ব মেনে চলার ‘স্ট্র্যাটেজি’।
স্বাভাবিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘আচরণ’ নজর এড়ায়নি বিরোধীদের। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও লোকসভা দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী কিসের জন্য প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছেন তা সবাই জানে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে রাজ্য সরকারের। মোদিজির কাছে তার-ই সমাধানসূত্র খুঁজতে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী।’ অধীর এও বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী যে মৌনতা ধারণ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রাজ্যে চুরি করে এসে, মুখ খুলবেন কি ভাবে?’ তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা ও দলের মুখ্য সচেতক সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কোটি কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে রাজ্যের। এ নিয়ে আগেও সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বহুবার চিঠি দিয়েছেন, মুখোমুখি সাক্ষাৎ করেও জানিয়েছেন দাবি৷’ সুখেন্দুর মতে, ‘এই সব বকেয়া মেটানো জরুরি। রাজ্যের জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশাবাদী যে এদিনের বৈঠকের পর রাজ্যের বকেয়া মেটাতে উদ্যোগী হবেন প্রধানমন্ত্রী।’ এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বিজেপির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষও। প্রসঙ্গত, চারদিনের এই দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট তিন বার সাক্ষাৎ হওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। এদিনের বৈঠকের পর, শনিবার রাষ্ট্রপতি ভবন পরিসরে কেন্দ্রের ‘আজাদি কি অমৃত মহোৎসব’ বিষয়ক বিশেষ কেন্দ্রীয় বৈঠকে অংশ নেবেন মমতা, যে বৈঠকে থাকার কথা মোদি-সহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শায়ের। এছাড়া রবিবার নীতি আয়োগের বৈঠকেও মোদির সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেবেন মমতা। কিন্তু এ নিয়ে কোনও ব্যক্তিগত অভিমত মমতা আদৌ তুলে ধরেন কি না সংবাদমাধ্যমে, তা-ই দেখার অপেক্ষা।